রাত ১০টার মত বাজে তখন। হাটতে বেরোলাম, উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। হঠাৎ করেই ইচ্ছা হল মাঝরাত পর্যন্ত এক ম্যারাথন হাঁটা দেই।
হাটতে হাটতে চলে আসলাম মতিঝিলে শাপলা চত্তর এর কাছাকাছি। এমন সময় হঠাৎ একটি ব্যাপার চোখে পড়ল। ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার এ॰টি॰এম বুথ এর দরজার সিড়িতে হালকা আলো জ্বলছে আর সেখানে ২৩ (আনুমানিক) বছরের এক ছেলে বসে আছে, তার সামনে একটি টুলে দুটি বই খোলা, দুটিই ইংরেজি বই। ছেলেটির গায়ে রাতের নিরাপত্তাকর্মীর (Security Guard) পোশাক। অবাক হয়ে গেলাম, কথা বলার খুব ইচ্ছা হল, কিন্তু কোন এক কারণে বলতে পারলাম না। তাকে অতিক্রম করে সামনে চলে গেলাম, কিন্তু মনটা কেমন খুতখুত করতে লাগল। ফেরত আসলাম ছেলেটার কাছে,জিজ্ঞেস করলাম…
আমি: ভাই কি পড়াশোনা করেন ?
ছেলেটি: অবাক হয়ে তাকিয়ে, জি ।
আমি: কিসে পড়ছেন এখন ?
ছেলেটি: ডিগ্রিতে সেকেন্ড ইয়ার।
আমি: শুনে আবারো কিছুটা আশ্চর্য হলাম, হাত এগিয়ে দিয়ে আমার পরিচয় দিলাম, এবং তাকে এখানে এভাবে পড়াশোনা করতে দেখে অবাক হওয়ার কথা বললাম।
বসে পড়লাম তার পাশে, এবং কথা শুরু হয়ে গেল দু’জনের। জানতে পারলাম, তার নাম জাহিদ, গ্রামের বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ, ঢাকায় এসেছে দু’মাস হয়, সেমিস্টার পরীক্ষা না দিয়ে ঢাকায় আসে চাকরীর জন্য কিন্তু যার চাকরি দেয়ার কথা সেই তখাকথিত বন্ধু তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গায়েব। শেষে বাধ্য হয়ে এই চাকরি করছে। দৈনিক ১২ ঘন্টা পরিশ্রমের বিপরীতে বেতন ৪২০০ টাকা। জানলাম তার জীবনের অনেক কথা, নিজের কথা, পরিবারের কথা, গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা, বিদেশে যাওয়ার জন্য দেড় লাখ টাকা দিয়ে তা খোয়ানোর কথা। তার কিছু স্বপ্নের কথাও শুনলাম। এবার গ্রামে গিয়ে যেভাবেই হোক পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা তার। জীবনে কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যাবহারের খুব কম সুযোগই হয়েছে তার কিন্তু কম্পিউটার ব্যবহার করার খুব ইচ্ছা তার। আরও ইচ্ছে,সন্তানদেরকে ভালমত বড় করার। এভাবে কথা বলতে বলতে কখন যে দেড় ঘন্টা পেরিয়ে গেছে টেরই পাইনি। আমার চলে আসার সময় হয়ে আসলো। কিন্তু, তাকে তো একা একা এই রাতে বসে নিজের কাজ করে যেতেই হবে, এবং সেটাও প্রতিদিন। বিদায় নিলাম তার কাছ থেকে। অনেক মন খারাপ অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম, কিন্তু ছেলেটির সাথে কথা বলে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলাম।

আচ্ছা, এই মানুষটি কি আমার বা আপনার চেয়ে কোন অংশে কম ??
তারও আমার মত মেধা রয়েছে, কিন্তু একটি জিনিসের ব্যবধানের কারনে আমরা তাদেরকে ছোট করে দেখি, আর সেটা হলো তার হয়তো আপনার বাবার মত এত টাকা নেই। হয়তো জাহিদের সাথে কথা না বললে আমিও তাকে ছোট করেই দেখতাম। আমাদের মাঝখানে Security Guard আর আমি পড়াশোনা করছি ভদ্র ছাত্র এই ব্যাপারগুলো কে নিয়ে আসতাম, আর নিজেকে তার চেয়ে অনেক বেশি বড় রকমের কেউ মনে করতাম। তাকে বলতাম সামান্য Security Guard॰
আমরা যখন সামান্য বিপদ অথবা প্রতিবন্ধকতা আসলেই দোষারোপ করতে থাকি ভাগ্যের, আর হায় হায় করতে থাকি, সেখানে সে তার সব প্রতিকুলতাকে মেনে নিয়ে ই সামনে যাওয়ার চেষ্টা করছে, সেই মানুষ কী আসলেই সামান্য Security Guard, নাকি আমাদের চেয়েও বড় কেউ ??
কেমন হলো জানাবেন। ভাল লাগলে শেয়ার করতে পারেন বন্ধুদের সাথে। কোণ প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানাতে পারেন। ধন্যবাদ সবাইকে।